ওয়ারেন, ১৪ অক্টোবর : সিঁদুর খেলা ও ধুনচি নাচের মধ্য দিয়ে মিশিগানে শেষ হয়েছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। পুজো শেষ মানেই আনন্দও শেষ। তবে ঘরের মেয়েকে বিদায় জানাতে মনখারাপ ও চোখের জলে নয়, হাসি মুখে সিঁদুর খেলা হয়। বাঙালি হিন্দু মহিলারা বিজয় দশমীর দিন, দুর্গাকে বিদায় জানানোর আগে সিঁদুর খেলেন। বিশ্বাস করা হয় এর মধ্যে দিয়ে সৌভাগ্য ও স্বামীদের দীর্ঘায়ু বয়ে আনা হবে।
গত ২অক্টোবর দেবী দুর্গার আবাহন বা মহালয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় দেবী পক্ষের। আর মহাষষ্ঠী পূজার মধ্য দিয়ে ৮ অক্টোবর শুরু হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। এরপর একে একে ষষ্ঠী থেকে দশমী। সবগুলো তিথিতেই মিশিগানের পূজামণ্ডপগুলো ছিলো পূজারীদের বিনম্র প্রার্থণা আর নানান আনুষ্ঠানিকতায় পরিপূর্ণ। এদিকে গতকাল বিকেল থেকেই ভক্তরা মিশিগান শিব মন্দির টেম্পল অব জয়ে বিজয়ার শান্তির জল ও প্রশস্তি বন্ধনের জন্য আসতে শুরু করেন। বিকেল ৫টায় সঙ্গীতানুষ্ঠনে গান পরিবেশন করেন বলিউড গায়িকা সাবেরী ভট্টাচার্য। হল ভর্তি দর্শকরা উপভোগ করেন তার পরিবেশিত গান। তিনি গেয়ে শোনান বেশ কিছু জনপ্রিয় হিন্দি ও বাংলা গান। সুরের তালে নেচে গেয়ে দর্শক শ্রোতাদের উন্মাতাল করে তোলেন তিনি।
রাত ৯টায় শুরু হয় আকর্ষনীয় আরতি ও ধুনচি নাচ। অন্তরা অন্তির কোরিওগ্রাফিতে ঢাকের বাজনার সঙ্গে আকর্ষনীয় আরতি ও ধুনচি নাচ সকলের নজর কাড়ে। এই ধুনুচি নাচ আসলে দেবী দুর্গাকে উৎসর্গ করা হয়। পুরাণ অনুযায়ী, দেবী দুর্গা নিজে ধুনুচি নাচ নেচে ছিলেন নিজের মধ্যে শক্তির সঞ্চারের জন্য। দেবতারা যখন মা দুর্গাকে জাগিয়ে তুলেছিলেন, সেই সময় দেবী নিজের মধ্যে শক্তি বৃদ্ধি করতে এই ধুনুচি নাচ নেচে ছিলেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, সেই থেকেই চলছে এই পরম্পরা।
বাঙালি হিন্দু মহিলারা বিজয় দশমীর দিন, সিঁদুর খেলেন। এই দিন বাঙালি বধূরা সাধারণত লাল পাড় সাদা শাড়িতে সেজে ওঠেন ৷ আরতির পর বিবাহিত নারীরা সিঁদুর, পান, ফল ও মিষ্টি নিয়ে ‘দুর্গা-মা’কে সিঁদুর ছোঁয়ানোর পর তারা একে অপরের সিঁথিতে সিঁদুর দেন। সেই সাথে শাখাতেও সিঁদুর ছোঁয়ানো হয়। সিঁথিতে সিঁদুর মাখানোর পর আঙুলে লেগে থাকা বাকি সিঁদুর তারা একে অপরের মুখে মাখেন। সিঁদুর খেলা শুধুমাত্র উৎসবের আনন্দই নয়, নারীর শক্তি, সৌভাগ্য এবং সংসারের মঙ্গল কামনার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
কথিত আছে যে এই সিঁদুর লাগালে বিবাহিতরা সৌভাগ্যবতী হওয়ার বর পান ৷ সিদুঁর খেলা স্বামীর দীর্ঘায়ু ও সুখময় জীবন হয়। সিঁদুর খেলার আচারটি এখন আরও বিস্তৃত ৷ এখন অবিবাহিত মেয়ে, এমনকী বিধবা ও পুরুষরাও সিঁদুর খেলায় সামিল হন ৷ নারীরা তাদের ও পরিবারের কল্যাণে এ ধর্মীয় আচার পালন করেন প্রতি বছরের দুর্গোৎসবে। সিঁদুর খেলার প্রাথমিক ইতিহাস অজানা। তবে ধারণা করা হয়, সিঁদুর শুভক্ষণের এই আচার অনুষ্ঠান আনুমানিক ৪শ বছর আগে শুরু হয়েছিল।
এর আগে বিসর্জন পর্বে শান্তিজল গ্রহণ ও প্রশস্তি বন্ধন অনুষ্ঠানে মন্দিরের প্রধান প্রিস্ট পুর্ণেন্দু চক্রবর্তী অপু পৌরহিত্য করেন। পরে তিনি ভক্তদের মাথায় ছিটিয়ে দেন শান্তির জল। এ সময় ভক্তরা উচ্চকন্ঠে ধ্বনি তুলেন ‘বল দুর্গা মা কি জয়’। সেই সঙ্গে সকলেই শেষবারের মতো প্রণাম করেছেন মাকে। শান্তির জল গ্রহণ ও প্রশস্তি বন্ধন শেষে নারী পুরুষ সকলেই একে অপরকে আলিঙ্গনও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। সবশেষে আগত ভক্তবৃন্দকে বিজয়ার মিষ্টিমুখ করানো হয়েছে। বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময়ে প্রবাসী ঘরে ঘরেও উৎসব শেষে চিরন্তন মনখারাপের সুর। প্রবাসের জীবন কর্মময় ও রুটিন মাফিক। উৎসব প্রিয় জাতি বাঙ্গালি এই কটা দিন সব হিসাব ওল্টা-পাল্টা করে মেতে ওঠেছিল পূজার আনন্দে। এই কটা দিনের বেহিসাবি জীবন থেকে আজ পুনরায় রোজকার ছন্দে ফিরবে সবাই।
সনাতন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, মহালয়ার দিন কন্যারূপে ধরায় আসেন দুর্গা। আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের দশমী তিথিতে তিনি কৈলাস পাড়ি দেন। এদিন বিসর্জনের মধ্য দিয়ে তাকে এক বছরের জন্য বিদায় জানানো হয়। আর এই দিনটি বিজয়া দশমী নামে পরিচিত। পুরাণে মহিষাসুর বধ সংক্রান্ত কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহিষাসুরের সঙ্গে ৯দিন, ৯ রাত যুদ্ধ করার পরে ১০ম দিনে তার বিরুদ্ধে বিজয় লাভ করেন দেবী। আর এই দিনটি ছিল শুক্ল পক্ষের দশমী।
বিজয়া দশমী সেই বিজয়কেই চিহ্নিত করে। শাস্ত্র মতে, এ বছর দেবী দুর্গার আগমন হয় দোলায় বা পালকিতে। দেবীর এই আগমনের ফলাফল হবে মড়ক। যা শুভ ইঙ্গিত নয়। এছাড়াও দেবী স্বর্গে গমন করবেন ঘোটকে বা ঘোড়ায়। শাস্ত্রমতে দেবীর গমন বা আগমন ঘোটকে হলে ফলাফল ছত্রভঙ্গ হয়। শাস্ত্রমতে এই ঘোটকে গমনের ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খল অবস্থাকে ইঙ্গিত করে। এটি যুদ্ধ, বিগ্রহ, অশান্তি, বিপ্লবের ইঙ্গিত দিয়ে থাকে।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Suprobhat Michigan